” যখন সমগ্র ভারত গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন – তখন বরিশাল ছিল সদা জাগ্রত ” – বরিশালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী এপ্রিল ১৯২১ এ কথা বলেন। বরিশালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা অশ্বিনী কুমার দত্ত ও স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী’র মূল নাম সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বরিশাল বিপ্লবী দলের প্রতিষ্ঠাতা ও বরিশালের শংকর মঠের প্রতিষ্ঠাতা তিনি । তার পৈত্রিক নিবাস উজিরপুর। তার পিতা ষষ্ঠী চরণ মুখোপাধ্যায় গলাচিপা থানার ওসি ছিলেন। সতীশ চন্দ্র ১৮৮৪ সনের ১২ই আগষ্ট গলাচিপায় জন্ম গ্রহণ করেন।
১৯০১ সালে তিনি উজিরপুর স্কুল হতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে বিএম স্কুলে শিক্ষকতার কাজে ব্রতী হন এবং অশ্বিনী কুমার দত্তের নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন। তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তৎকালীন সময়ে বরিশালের সবথেকে শক্তিশালী বিপ্লবী সংগঠন “স্বদেশ বান্ধব সমিতি” এর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি। বরিশালের বিপ্লবী ঘাটি “যুগান্তরের” বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। ১৯০৬-এ বরিশালের প্রাদেশিক সম্মেলনের সময় গুপ্ত সমিতির পরিচালক বারীন্দ্র কুমার ঘোষ সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে একটি রিভলবার উপহার দিলেন। ১৯০৮ সনের শেষে দিকে তখন পণ্ডিত সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ব্রজমোহন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। ব্রজমোহন কলেজে (বর্তমানে সরকারি ব্রজমোহন কলেজ) সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি ও ভক্তিমূলক গানের অনুষ্ঠান হতো। সংস্কৃত ভাষায় ভাগবৎ স্ত্রোত্র পাঠ হতো। যুবকরা অনেকেই এখানে উপস্থিত থাকত। বৃটিশ রাজ্যের রোষানলে পড়ে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অশ্বিনী কুমার দত্তের বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ড বাঁধার সৃষ্টি হতে লাগল। প্রশাসনিক বিরোধিতার ফলে যে কোন মহৎ কাজ সুষ্ঠুভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই অক্সফোর্ড মিশনের মি. স্ট্রং-এর পরামর্শে বরিশাল বিএম কলেজ সরকারি সাহায্য লাভের বিনিময়ে শর্তাধীনে পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হলো। এটা সতীশ বাবুর মনপুত ছিল না। প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করা তার এখতিয়ার বহির্ভূত। এ জন্য তিনি মনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বিএম স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন। এসময় বিপ্লবী নেতাদের সাথে অশ্বিনীকুমার গ্রেফতার হলে “স্বদেশ বান্ধব সমিতি” এর দেড় শতাধিক শাখার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং নোয়াখালী নিবাসী বিএম স্কুলের ছাত্র নরেন্দ্র মোহন ঘোষ চৌধুরী সহায়তার সতীশ চন্দ্র বরিশালে গুপ্ত সমিতি গঠন করেন।
১৯০৯ এ এই প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বে-আইনি ঘোষিত হওয়ার পর তিনি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সাথে পড়াশুনা ও আধ্যাত্ব সাধনায় নিয়োজিত হন।
এর পরেই সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় কিছুটা ধর্ম সাধনার প্রতি অনুরাগী হলেন। চলে গেলেন কাশীতে। সংস্কৃত শিক্ষা লাভের নিমিত্তে। নিজে বেদ অধ্যয়ন করতেন, সাথে সাথে অন্যকেও শিক্ষা দিতেন। কাশী থেকে ফিরে এসে তিনি পরিপূর্ণভাবে এক সন্ন্যাসীরূপে সমাজে পরিচিতি লাভ করলেন। তিনি সন্ন্যাস নাম ধারণ করেন স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী। এ নামেই সকলে চিনত। ইংরেজি ১৯১১ সনের ডিসেম্বর মাসে গয়াধামে গিয়ে মহাতাপস স্বামী শংকরার্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন।
১৯১২ সালে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প নিয়ে বিএম কলেজের সন্নিকটে রাস্তার পাশে সম্পত্তি কিনে গড়ে তুলেন এক আশ্রম। আশ্রমের নাম দেয়া হয় শ্রীশ্রী শংকর মঠ। আশ্রমের উদ্দেশ্য ছিল স্বাদেশিকতা। ভারত মাতার মুক্তি সংগ্রাম। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পূজা অর্চনা হতো। পাঠশালাও চালু করেন। গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি জানতে পারে যে, আশ্রমের নামে এখানে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তাই গোয়েন্দারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার জন্য শংকর মঠের ঠিক রাস্তার ওপারেই একটি গোয়েন্দা অফিস স্থাপন করে।
১৯১৫ সনে সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় (স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী) কাশীতে গিয়েছিলেন। সেখানে সরকার তাকে বিপ্লবী তৎপরতার জন্য গ্রেফতার করে এবং মেদিনীপুরের মহিষাদলে স্থানান্তর করে। তার অবর্তমানে মনোরঞ্জন গুপ্ত ও হীরালাল দাস গুপ্ত পার্টির কাজ চালিয়ে যান। শত শত বিপ্লবীরা শংকর মঠে দীক্ষা গ্রহণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯১৯ সনে তিনি অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি লাভের পরই সরাসরি তিনি বরিশালে চলে আসেন। শংকর মঠ আশ্রমের সম্পত্তি (স্থাবর-অস্থাবর) পরবর্তীতে যাতে তার কোন ওয়ারিশ দাবি না করতে পারে, এ জন্য আইনগতভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ সমুদয় সম্পত্তি তিনি শংকর মঠ আশ্রমের নামে ট্রাস্টি ডিড করে যান।
১৯২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় থাকাকালে পরলোক গমন করেন তিনি। তার মরদেহ ৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে আনা হলে প্রজ্ঞানান্দকে তারই প্রতিষ্ঠিত শংকর মঠে সমাধিস্থ করা হয়।
তাঁর রচিত গ্রন্থঃ রাজনীতি, বেদান্ত দর্শনের ইতিহাস, কর্মতত্ত্ব, সবলতা ও দুর্বলতা। তাঁকে “বিপ্লবী গুরু” নামে অভিহিত করা হয়। তাঁর নামে কলকাতায় তাঁর এক শিষ্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম – শিবপুর শ্রীমৎ স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয় (Sibpur S.S.P.S Vidyalaya)
ছবিঃ শংকর মঠ, বরিশাল / Abul Ahsan Moni / Flickr
Leave A Comment